ম্যাচ-পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে সাকিব আল হাসানের আসার বার্তা চিন্তার খোরাক দেয়। সাংবাদিকদের মাথায় তখন ঘুরপাক খাচ্ছে নানা প্রশ্ন। কোনটা রেখে কোনটা করা হবে। ক্রিকেটার সাকিবের রাজনীতিতে যোগা দেওয়া ভুল ছিল কিনা, ভুল স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইবেন কিনা; আরও অনেক প্রশ্নের ভিড় তখন মাথায়। কিন্তু এসবের কিছুই করা হলো না। সাকিব টেস্ট ও টি২০ থেকে অবসরের ঘোষণা দেওয়ায় মুহূর্তে সংবাদ সম্মেলনের পরিবেশ বদলে যায়।
দেশে ফিরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে নড়েচড়ে বসেন সাকিব। ভরা সংবাদ সম্মেলনে বাঁহাতি এ অলরাউন্ডার অনেক কিছু বলার পর জানান, টেস্ট ক্রিকেট ছাড়ছেন। সেটা দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হলে ভালো। না হলে আজ থেকে শুরু হওয়া কানপুরে টেস্টে ইতি টানবেন।
বিসিবি ও সরকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে এবং শেষ টেস্ট খেলে দেশ থেকে নিরাপদে বিদেশে যাওয়ার নিশ্চয়তা পেলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মিরপুর টেস্ট খেলে সাদা পোশাক চিরতরে তুলে রাখতে চান তিনি। টি২০ খেলা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জানান, বিশ্বকাপেই কুড়ি ওভারের শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছেন। বিসিবি সুযোগ দিলে পাকিস্তানে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলে ওয়ানডে থেকে বিদায় নেবেন। তবে গতকাল মিরপুরে বোর্ড সভা শেষে বিসিবিপ্রধান ফারুক আহমেদ জানিয়ে দিয়েছেন, সাকিবকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দেওয়ার সামর্থ্য বোর্ডের নেই।
‘আমি তো আসলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ না। একজনকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। সেটা আসলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিক থেকে এবং তার দিক থেকে আসতে হবে। বোর্ড থেকে ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার সামর্থ্য বিসিবির নেই।’
বিসিবিপ্রধানের কথাতেই পরিষ্কার, দেশে ফিরে টেস্ট থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেওয়া, ফেব্রুয়ারি-মার্চে পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার সুযোগ সাকিবের চাওয়া হলে শেষ পর্যন্ত এগুলো চাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যেতে পারে। কারণ ক্রিকেটারের বাইরেও রাজনৈতিক পরিচয় আছে তাঁর।
তিনি পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সংসদ সদস্য ছিলেন। তাই দেশের বর্তমান বাস্তবতায় সাকিবের দেশে ফেরা চ্যালেঞ্জিং। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা (বোর্ড) চেষ্টা করছে, এটাকে (বিদায়) কীভাবে সুন্দরভাবে ব্যবস্থা করা যায়। আমি যাতে নিরাপদ মনে খেলতে পারি এবং খেলা শেষে দেশের বাইরে বের হতে যেন সমস্যা না হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই জিনিসগুলো বোর্ড খেয়াল করছে এবং যারা এগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা বিষয়টি দেখবে এবং দেখছেন বলে আমি মনে করি। তারা হয়তো আমাকে একটা সিদ্ধান্ত দেবে, যেটার ভিত্তিতে দেশে গিয়ে ভালোভাবে খেলে অন্তত টেস্ট ক্রিকেটটা ছাড়তে পারব।’
ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর দেশে মামলার ঘটনা ঘটতে থাকে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে গার্মেন্টকর্মী হত্যা মামলার হুকুমের আসামি করা হয় সাকিবকে। সম্প্রতি শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে তাঁকে।
এ প্রসঙ্গে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলে বলেন, ‘আপনারা জানেন, কেমন ধরনের কেস, আমি তখন কোথায় ছিলাম বা আমার কাজ কী ছিল, কী করছিলাম। এসব নিয়ে আমি বেশি কিছু বলতে চাই না। আরেকটি জিনিস যেটা এসেছে, আমি নিজের থেকে কখনও ট্রেড ওন (শেয়ার) করিনি। কেউ যদি বলে আমি এটা নিয়ে কথাও বলেছি, প্রমাণ দিলে আমি খুব খুশি হবো। এগুলো সুন্দর করে করলে আমার জন্য হয়তো একটু ভালো হতো।
মিথ্যা অভিযোগগুলো ভালো দিক বহন করে না, দেশের জন্যও খারাপ।’ এ পরিস্থিতিতে সাকিবের দেশে ফেরাকে নিরাপদ মনে করছেন না ক্রিকেট-সংশ্লিষ্টরা। এ ব্যাপারে সাকিব বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত খেলায় আছি। যেহেতু দেশে অনেক পরিস্থিতি আছে, স্বাভাবিকভাবে সব কিছু হয়তো আমার ওপরে না। ওই জিনিসগুলা বিসিবির সঙ্গে আলাপ করেছি। তাদের আমার পরিকল্পনা জানিয়েছি। আশা করেছিলাম, হোম সিরিজটি আমার শেষ সিরিজ হবে। ফারুক ভাই, বোর্ড পরিচালক ও নির্বাচকদের সঙ্গে কথা বলেছি। বাকিটা তাদের সিদ্ধান্ত।’
২০২৩ সালে সাকিব বলেছিলেন, বিশ্বকাপ দিয়ে আন্তর্জাতিক টি২০ শেষ করতে চান। টেস্ট ক্রিকেট থেকে বিদায় নিতে চেয়েছিলেন বছরের শেষ সিরিজ খেলে। ওয়ানডেকে বিদায় জানানোর পরিকল্পনা ছিল ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি দিয়ে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আগেভাগে শেষ করতে হচ্ছে তাঁকে।
বিদেশের মাটিতে সম্প্রতি ভালো খেলছেনও না তিনি। চেন্নাই টেস্টে বোলিং-ব্যাটিং ভালো করতে না পারায় সাকিবকে একাদশে রাখা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাস্তবতা উপলব্ধি করে টেস্ট ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বলে জানা গেছে। যদিও তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, স্বেচ্ছায় টেস্ট ক্রিকেট ছাড়ছেন, ‘কষ্ট বা অভিমান থেকে অবসর নেওয়া না। মনে হয়েছে, এটা ছেড়ে দেওয়ার সঠিক সময়। নতুনদের আসার সুযোগ দেওয়ার জন্য। টি২০তে আমার একই রকম চিন্তা। অপ্রাসঙ্গিক হলেও আমি বলে ফেলতে চাই। টি২০ নিয়েও কথা হয়েছে নির্বাচক, বোর্ড সভাপতির সঙ্গে। টি২০ও ছেড়ে দিচ্ছি। আপাতত সিরিজগুলোতে নতুনরা আসুক, নতুনরা খেলতে থাকুক।’
২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক সাকিবের। ২৪৭টি ৫০ ওভারের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ৯টি সেঞ্চুরি, ৫৬টি হাফ সেঞ্চুরিতে ৩৭.২৯ গড়ে ৭ হাজার ৫৭০ রান করেছেন বাঁহাতি এ অলরাউন্ডার। ওয়ানডের উইকেট ৩১৭টি। ৭০ টেস্টে ৪ হাজার ৬০০ রান ও ২৪২টি উইকেট নিয়েছেন। ১২৯ টি২০তে ২ হাজার ৫৫১ রান ও ১৪৯টি উইকেট শিকার তাঁর। ক্যারিয়ারের সিংহভাগ সময় বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার ছিলেন তিনি। দেশের ক্রিকেটে রেকর্ডের বরপুত্র বলা হয় সাকিবকে।
তিনি জানান, কোনো রকম অতৃপ্তি নেই তাঁর। তিনি বলেন, ‘আমি হ্যাপি, আমার কোনো অনুশোচনা নেই। জীবনে কোনো অনুশোচনা ছিল না, এখনও নেই। যতদিন উপভোগ করেছি, ক্রিকেট খেলেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটাই বিদায় নেওয়ার সঠিক সময়। বোর্ড, কোচ, অধিনায়ক সবার সঙ্গে কথা হয়েছে, তারাও একমত হয়েছেন– এটাই আমার জন্য সঠিক সময়। আশা করি, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি দিয়ে ওয়ানডে থেকে অবসর নেব।’
যে সাকিবের দেশে রাজকীয় বিদায় হতে পারত, দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণির দর্শকের বাহবা হতে পারত বিদায়ী স্লোগান, তিনিই কিনা বিদায় নিশ্চিত করে দেশ ছাড়ার নিশ্চয়তা চেয়েছেন। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হওয়ার মতো একটি ভুল সাকিবের জন্য সারা জীবনের হতাশা হয়ে থাকবে।