দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই সরকারকে নানা রকম আর্থিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। আমি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের দিকে যাব না। কারণ আমি রাজনীতিবিদ নই। রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের বিষয় রাজনীতিবিদরাই ভাববেন। আমি নতুন সরকারের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে কিছু কথা বলব। নতুন সরকারকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, তা তাত্ক্ষণিকভাবে সৃৃষ্ট কোনো সমস্যা নয়। এসব সমস্যা আগে থেকেই বিদ্যমান রয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের ডামাডোলে সরকার গত কিছুদিন ধরে এসব সমস্যার ব্যাপারে হয়তো তেমন একটা দৃষ্টি দিতে পারেননি। এখন নতুনভাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারকে বিদ্যমান সেই সব সমস্যা সমাধানের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে সরকারকে বিশেষভাবে ভাবতে হবে। কারণ ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া অধিকাংশ ব্যাংকেই অভ্যন্তরীণ সুশাসনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব মোতাবেক, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এটা এ যাবত্কালের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ খেলাপি ঋণ। কিন্তু এটা খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থার নির্দেশক নয়। কারণ এর সঙ্গে ঋণ হিসাব অবলোপনকৃত ঋণাঙ্ক যোগ করা হয়নি। একই ভাবে মামলাধীন প্রকল্পের নিকট দাবিকৃত অর্থ এবং ঋণ হিসাব পুনঃ তপশিলিকৃত ঋণাঙ্ক যোগ করা হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি হবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত শুধু বাড়ছেই। কোনোভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো যাচ্ছে না।
খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থার পরিচালন-ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই অবস্থায় আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে খুব বেশি আগ্রহী হচ্ছে না। ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাওয়ার মতো পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। অধিকাংশ ব্যাংকই কমবেশি তারল্য-সংকটে পতিত হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ব্যাংকের তারল্য-পরিস্থিতি নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। তারা মাঝে মাঝেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় ধার নিয়ে তাদের সমস্যা মেটাচ্ছে। ব্যাংকগুলো যদি আমানত সংগ্রহ করতে না পারে তাহলে তাদের তারল্য-সংকট দেখা দেবেই। তারল্য-সংকটের কারণ ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তাদের কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ঋণদান করতে পারছে না। ব্যক্তি খাতে ঋণ দানের পরিমাণ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক নিচে রয়েছে। উদ্যোক্তাগণ ঋণের জন্য ব্যাংকে ধর্ণা দিলেও ব্যাংকগুলো তাদের আবেদিত ঋণ দিতে পারছে না। এজন্য তারল্য-সংকটই দায়ী। তারল্য-সংকট ব্যাংকের স্বাভাবিক চলার পথকে রুদ্ধ করতে পারে। এর থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে ব্যাংকগুলো এই সংকট থেকে উত্তরণ লাভ করে স্বাভাবিক গতিতে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
বাংলাদেশের মতো একটি বিকাশমান অর্থনীতির জন্য সুস্থ ধারার ব্যাংকিং সেক্টর বিদ্যমান থাকা খুবই জরুরি। আমাদের দেশে উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা পুঁজির জন্য মূলত ব্যাংকিং সেক্টরের ওপরই নির্ভর করে থাকেন। ব্যাংকিং সেক্টরই তাদের জন্য একমাত্র ভরসার ক্ষেত্র। সেই ব্যাংকিং সেক্টর যদি তাদের ঠিকমতো সাপোর্ট দিতে না পারে, তাহলে তারা কোথায় যাবেন? ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান পর্বত-প্রমাণ খেলাপি ঋণসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে আইনি সংস্কার করা যেতে পারে। যেভাবেই হোক ব্যাংকিং সেক্টরের সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা করতে হবে। তবে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাংকিং সেক্টরের সমস্যা সমাধানে কতটা দৃঢ়তার সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতি অনেক দিন ধরেই বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হয়ে রয়েছে। ২০২৩ সালে আমাদের অর্থনীতির যে গতিধারা, তাতে মনে হচ্ছে ২০২৪ সালে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এখানে আমি অর্থনীতির কয়েকটি সূচকের কথা উল্লেখ করব। এখনো আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত হচ্ছে পণ্য রপ্তানি সেক্টর। ২০২৩ সালে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে দুই শতাংশেরও কম। জনশক্তি রপ্তানি খাত হচ্ছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত। সেখানেও প্রবৃদ্ধির হার তিন শতাংশের কম, যদিও ২০২৩ সালে প্রায় ১৩ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে গমন করেছে কর্মসংস্থান উপলক্ষ্যে। কিন্তু রেমিট্যান্সের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম। ২৭ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ছিল ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটা ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৩-এ ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব। আইএমএফের হিসাব মোতাবেক এর পরিমাণ আরো কম হবে। আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাইনাস ১৬ শতাংশ। শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য এগুলোও তো আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আগের অর্থবছরের (২০২২-২০২৩) একই সময়ের তুলনায় ঋণপত্র খোলার হার কমেছে ১৪.০৬ শতাংশ। এর মধ্যে ভোগ্যপণ্যের ঋণপত্র খোলা কমেছে ২৭.৪৭ শতাংশ। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৩৬৪ কোটি মার্কিন ডলারের। গত বছর এই খাতে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ২৬৪ কোটি মার্কিন ডলারের। একই ভাবে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ১১৬ কোটি মার্কিন ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৯৬ কোটি মার্কিন ডলারের বা ১৬.৯৮ শতাংশ কম। শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল আমদানির জন্য ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ১ হাজার ৪১ কোটি মার্কিন ডলারের। আর গত অর্থবছরের একই সময়ে কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৯২০ কোটি মার্কিন ডলারের বা ১১.৬২ শতাংশ কম। মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৪৪ কোটি মার্কিন ডলারের। গত বছর একই সময়ে মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৪০৭ কোটি মার্কিন ডলারের বা ৭.৫২ শতাংশ কম। শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমে যাওয়া কোনোভাবেই শুভ লক্ষণ হতে পারে না। এসব পণ্যের আমদানি কমে যাবার অর্থই হচ্ছে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্থবিরতা নেমে এসেছে। ব্যক্তি খাতে শিল্প বিনিয়োগে কমে যাবার অর্থই হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে মন্থরতা তৈরি হবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম বিঘ্নিত হবে। তাই সব পণ্যের আমদানি কমে যাওয়াটা ভালো লক্ষণ হতে পারে না।
মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার ক্রমশ অবমূল্যায়ন হচ্ছে। ২৭ ডিসেম্বর আন্তঃব্যাংক মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকায় চলে গেছে। স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে তা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। গত এক বছর ধরেই আমাদের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিরাজ করছে। সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর রয়ে গেছে। এর ফলে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করা মানুুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
আর একটি পুরোনো সমস্যা রয়েছে অনেক দিন ধরেই, যার কোনো সমাধান হচ্ছে না। সেটা হলো আয়বৈষম্য। বর্তমানে দেশে তীব্র আয়বৈষম্য বিরাজ করছে। আয়বৈষম্যসূচক নির্ণয়ের জন্য একটি পদ্ধতি আছে, যাকে গিনি সহগ বলা হয়। গিনি সহগ মোতাবেক আয়বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এখন আয়বৈষম্য জিরো পয়েন্ট ৪৯৯-এ উন্নীত হয়েছে। আয়বৈষম্য জিরো পয়েন্ট ৪৫-তে উন্নীত হলে তাকে ভয়াবহ অবস্থা বলা হয়ে থাকে। জাতীয়ভাবে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি পাশাপাশি আঞ্চলিক আয়বৈষম্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি আমাদের দেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে সবচেয়ে জটিল সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। কোনোভাবেই এই সমস্যা সমাধান করা যাচ্ছে না। অনেকেই বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ালেই মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। আমি তা মনে করি না। সুদের হার বাড়ালেই মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, এটা না-ও হতে পারে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ালে ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। একই সঙ্গে উত্পাদন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়বে। ফলে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম বিঘ্নিত হবে। মূল্যস্ফীতি কমনোর একটি উপায় আছে তা হলো, আমদানি পণ্যের শুল্ক কমানো। আমদানি পণ্যের শুল্ক হার কমালে অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের মূল্য কমে আসতে পারে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে; এবং মনোপলি প্রাইসিং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আমি যখন অর্থউপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলাম, তখন ভোজ্য তেলের ওপর আরোপিত আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিলাম। পরের দিন দেখা গেল বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়ে গেল। এরপর আমি ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীদের ডেকে এনে বললাম, তোমাদের ঋণ দান বন্ধ করে দেবো। তখন দেখা গেল বাজারে ভোজ্য তেলের মূল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে এসেছে।
লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা
অনুলিখন :এম এ খালেক