অস্থির পেঁয়াজের বাজার। গেল আট থেকে ১০ দিনে দাম বাড়তে বাড়তে এখন কেজি ১২০ টাকায় ঠেকেছে। হঠাৎ এমন দামের ঝাঁজে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে আশ্বাস বাণী শোনাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ভারতের বিকল্প হিসেবে কয়েকটি দেশ থেকে আমদানির জন্য খোলা হয়েছে ঋণপত্র (এলসি)। এ মাসের শেষ নাগাদ আমদানি করা পেঁয়াজ ঢুকতে পারে বাজারে। তখন দাম অনেকটাই কমতে পারে।
পেঁয়াজ প্রশ্নে ব্যবসায়ীরা আশার কথা শোনালেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বক্তব্যে বাজার পরিস্থিতি উন্নয়নে ইতিবাচক কোনো ইঙ্গিত নেই। বরং একে অন্যকে কথা বলার পরামর্শ ও কেউ ছুটিতে আছেন বলে এড়িয়ে যান।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, উৎপাদনসহ অন্য খরচ হিসাব করে খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজের যৌক্তিক দর ৬৫ টাকা হওয়ার কথা। তবে সংস্থাটিরই তথ্য, গত বৃহস্পতিবার খুচরায় পেঁয়াজের দর ছিল ৯৫ থেকে ১০৫ টাকা। তবে বাজারের প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। শনিবার রাজধানীর শান্তিনগর, সেগুনবাগিচা, হাতিরপুল, কারওয়ান বাজারসহ কয়েকটি বাজারে দেশি ভালো মানের পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। আর দেশি হাইব্রিড জাতের পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকায়। তবে পাড়া-মহল্লা ও এলাকাভিত্তিক ছোট বাজারে ১২০ টাকার কমে মিলছে না পেঁয়াজ।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) শনিবারের বাজারদর অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে দেশি ও আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। সংস্থাটি বলছে, এক মাসে দেশি পেঁয়াজের দর ২৭ ও আমদানি করা পেঁয়াজের দর ১৭ শতাংশ বেড়েছে। তবে এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে আরও বেশি। টিসিবি বলছে, এক বছরে দেশি পেঁয়াজের ৪০ ও আমদানি করা পেঁয়াজের ১৩৩ শতাংশ দর বেড়েছে।
ঢাকার শান্তিনগর থেকে শনিবার ১২০ টাকা দরে দেশি পেঁয়াজ কেনার পর দিনমজুর সাদেক আলী বলেন, ‘পেঁয়াজ ছাড়া তো রান্না করা যায় না। তবে এক সপ্তাহে কেজিতে ২০ টাকা বাড়ল। এভাবে দাম বাড়লে গরিবের সংসার চালানো খুব কষ্টকর হবে।’
কোরবানি ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে পেঁয়াজের কেজি শতকে ছুঁয়েছিল। এর পর ১০ থেকে ১৫ টাকা কমে নেমে আসে ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়। এর পর দাম আবার বাড়তে থাকে। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, দেশি পেঁয়াজের সঙ্গে বাজারে এ সময় আমদানি করা পেয়াঁজের সরবরাহ দেখা যেত। বিশেষ করে ভারত, মিয়ানমার, তুরস্ক ও পাকিস্তানের পেঁয়াজ থাকত। এখন আমদানি করা পেঁয়াজ নেই বললেই চলে।
কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজ-রসুন ব্যবসায়ী এরশাদ আলী জানান, আজ তিনি পাইকারি ১০৬ টাকা দরে পেঁয়াজ কিনেছেন। এর সঙ্গে অন্য খরচ আছে। বস্তা থেকে খোলার পর কিছুটা ঘাটতি থাকে। কিছু পচে যায়। মুনাফার বিষয় হিসাব করলে ১১৫ টাকার কমে বিক্রি করা যায় না।
ব্যবসায়ীদের হিসাবে প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ লাখ টনের মতো পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। যার ৯০ শতাংশই আসে ভারত থেকে। ভারত রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করলেই সঙ্গে সঙ্গে দেশে এর প্রভাব পড়ে। গত বছরের মাঝামাঝি ভারত প্রতি টন পেঁয়াজের ন্যূনতম দর বেঁধে দেয় ৫৫০ ডলার। এর পর রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এর পর থেকে কমতে থাকে আমদানি।
আমদানিকারকরা জানান, ভারত থেকে আনলে আমদানি খরচ বেশি। এ ছাড়া ডলারের দর বেশি থাকায় আমদানি খরচ বেড়েছে। এজন্য তারা আমদানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ফলে দেশি পেঁয়াজের ওপরই নির্ভরতা বেড়েছে। তবে ভারতের বিকল্প দেশ থেকে এ মাসের শেষ দিকে আমদানি হবে। তখন দাম কমবে।
ঢাকার শ্যামবাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মাজেদ বলেন, এখন যে কোনো দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি আছে। বেশি আমদানি হয় ভারত থেকে। তবে গত বছর ভারত তাদের পেঁয়াজ রপ্তানিতে যে ন্যূনতম দর নির্ধারণ ও শুল্ক আরোপ করেছিল, তা এখনও বহাল আছে।
অন্যদিকে, ডলারের দরও বেশি। ফলে ভারত থেকে আনতে গেলে প্রতি কেজি পেঁয়াজে খরচ ৮০ থেকে ৯০ টাকার মতো পড়ে। এজন্য অনেকেই দেশটি থেকে আমদানি করতে চান না।
হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানি গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশিদ বলেন, ভারত এখনও ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য প্রত্যাহার করেনি। রপ্তানি মূল্যের ওপর শুল্ক রয়েছে ২৫ শতাংশ। তাছাড়া অন্যান্য খরচ তো আছেই। সব মিলিয়ে কেজিতে খরচ পড়ে ৭০ টাকার বেশি। তবে ইতোমধ্যে ভিন্ন দেশ থেকে এলসি খুলেছেন অনেকেই। জাহাজে এসব দেশের পেঁয়াজ বন্দরে আসতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।
এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, নিত্যপণ্যের বাজারে একটার পর একটা সমস্যা লেগেই থাকে। এখন সমস্যা পেঁয়াজ-আলুর বাজারে। তবে ডিম আমদানির প্রয়োজন না হলেও পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। পেঁয়াজের বিষয়ে কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলতে পারবে।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম ও বাণিজ্য সচিব মো. সেলিম উদ্দিনকে ফোন করা হলে তারা ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া দেননি। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (আইআইটি) অনুবিভাগের প্রধান অতিরিক্ত সচিব মালেকা খায়রুন্নেছা ফোন ধরলেও এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। তিনি একই বিভাগের তাঁর অধস্তন কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ দাউদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
পরে দাউদুল ইসলামকে ফোন করলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে মালেকা খায়রুন্নেছা বলতে পারবেন। সেজন্য তাঁকে ফোন দেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু মালেকা খায়রুন্নেছাই তাঁকে জিজ্ঞেস করতে বলেছেন– এমন তথ্য দেওয়ার পর দাউদুল ইসলাম বলেন, মুখের কথায় অথরিটি হয় না। তাই আমি কিছুই বলতে পারব না।
পেঁয়াজের বাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়টি দেখভাল করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এ বিষয়ে জানতে সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিমকে ফোন দিলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
সংস্থাটির বাজার সংযোগ বিভাগের উপপরিচালক মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমি ছুটিতে আছি, তাই কিছু বলতে পারছি না।’ তবে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালক সুলতানা নাসিরা বলেন, ‘হ্যাঁ দাম বাড়ছে। এটা সবাই দেখছে। বাজার তদারকিও চলছে।’
গত ১০ দিনে পেঁয়াজের কেজি ২০ টাকা বেড়েছে– এর পেছনে কারণ কী জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা জানান, তিনি একটি অনুষ্ঠানে আছেন, অফিস টাইমে ফোন দিলে ভালো বলতে পারবেন।