একটা গোটা জাতি কীভাবে তার যাবতীয় আবেগ, একতা, তেজস্বী কণ্ঠস্বর আর বিশ্বাস দিয়ে সময়কে বদলে দিতে পারে, দেখেছে তা গোটা বিশ্ব। সেই একই মনের জোরে, একই ঐকতানে ক্রিকেটেও গৌরবযাত্রা রচনা করল লাল-সবুজের নতুন এক বাংলাদেশ– সেটাও এবার দেখল গোটা ক্রিকেটবিশ্ব। যেখানে টেস্টের শেষ দিনে পাকিস্তানকে ১৪৬ রানে অলআউট করার মতো অবিশ্বাস্য এক কীর্তি গড়েছেন মুশফিক-মিরাজরা।
২৪ বছর ধরে যে টেস্ট জয়ের জন্য হন্যে হয়ে ছিল বাংলাদেশ, গতকাল রাওয়ালপিন্ডিতে সেই পাকিস্তানের বিপক্ষেই প্রথম টেস্ট জয়ের ইতিহাস লিখলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। ২১ বছর আগে সেই ২০০৩ সালে মুলতান টেস্টে ইনজামাম-উল-হকের আউট না দেওয়ার যে প্রবঞ্চনা এতদিন কুরে কুরে খাচ্ছিল, রাওয়ালপিন্ডিতে সেই দ্বন্দ্বই যেন চাপা পড়ল প্রথমবারের মতো ১০ উইকেটে টেস্ট জয় করে। পিন্ডি জয়ের পর আইসিসির টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের খাতায়ও পাকিস্তানকে টপকে গেল এই সাহসী বাংলাদেশ। পাকিস্তানের মাটিতে শান মাসুদদের এভাবে পর্যুদস্ত করাই কি বিদেশের মাটিতে জেতা সাতটি টেস্টের মধ্যে সেরা– তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে না হয় যুক্তিতর্ক হোক। আপাতত পিন্ডি টেস্টে মুশফিকের ১৯১ রানের মুগ্ধতা, মিরাজের ৭৭ রান আর পাঁচ উইকেট শিকারের বিভোরতা আর সাকিবের ৪ উইকেটের সম্মোহ নিয়েই থাকুক বাংলাদেশের ক্রিকেট। উদ্বাহু অপেক্ষায় থাকুক টেস্ট সিরিজ জয়ের।
এদিন ঐতিহাসিক এই জয়ের পর পিন্ডির গ্যালারিতে লাল-সবুজের পতাকা হাতে বেশকিছু সমর্থক মুশফিকদের বাহবা দিয়েছেন। তবে তাদের মন যে পড়েছিল দেশের মানুষের জন্য। আর সে কারণেই অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত এই জয় উৎসর্গ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত সব শহীদের প্রতি। মুশফিকুর রহিম তাঁর ম্যাচসেরা হওয়ার পুরস্কারের সব অর্থ বন্যার্তদের সহায়তায় দান করেছেন। আসলে এবারের এই সফরটি তাদের জন্য আর অন্য সব সফরের মতো ছিল না। দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিসিবিতে একটা অচলাবস্থা চলছিল, অস্থিরতার মধ্যেই তাদের অনুশীলন বাদ পড়েছিল। মুশফিক ও মুমিনুলদের কেউ কেউ চট্টগ্রামে একটা ক্যাম্প করার পর শুধু অনুশীলনের ঘাটতি পোশাতেই পাকিস্তান সফরে ‘এ’ দলের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ দলকে পর্যাপ্ত অনুশীলনের সুযোগ করে দিতে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডও বাংলাদেশ দলকে নির্ধারিত সূচি এগিয়ে এনে আতিথেয়তা দিয়েছিল। টেস্ট শুরুর আগে ওপেনার মাহমুদুল হাসান জয়ের চোটে পড়ে ছিটকে যাওয়া, এমনকি ‘এ’ দলের হয়ে খেলতে গিয়ে মুশফিকের আঙুলে চোট পাওয়াটাও বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ ছিল। কিন্তু সব কিছুর পরও টস জিতে প্রথমে বোলিং নেওয়াটাই বোধ হয় ভালো সিদ্ধান্তের একটা ছিল। যেখানে প্রথম দিনের প্রথম সেশনেই ১৬ রানে পাকিস্তানের ৩ উইকেট ফেলে দেন বাংলাদেশের পেসাররা। তার পরও পাকিস্তান প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেটে ৪৪৮ রান করে ডিক্লেয়ার্ড করে।
শান মাসুদরা হয়তো ভেবেছিলেন, ওই রানই যথেষ্ট। চার পেসার নিয়ে নেমেছিল তারা বাংলাদেশের ইনিংসকে অল্প রানে গুটিয়ে দিতে। কিন্তু যেখানে ৩৫ ডিগ্রির ওপর তাপমাত্রা, সেখানে সেই রাওয়ালপিন্ডির পিচে শাহিন শাহ আফ্রিদিরা সুবিধা নিতে পারেননি। আর এখানেই ধৈর্য, সাহস ও দক্ষতার চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে সফলতা এনেছেন বাংলাদেশি ব্যাটাররা। যেখানে ওপেনার সাদমান ইসলাম অনিক ৩২৯ মিনিট ক্রিজে কাটিয়ে ৯৩ রানে জয়ের ভীত তৈরি করেন। অভিজ্ঞ মুমিনুল হক সৌরভ হাফ সেঞ্চুরি করেন, লিটন দাস মেজাজ ধরে রেখে কখনও সাবধানী, কখনও মারকুটে ব্যাটিং করেন। আর সবচেয়ে কার্যকরী জুটি গড়েন মুশফিক ও মিরাজ মিলে সপ্তম উইকেটে ১৯৬ রান তুলে।
ডাবল সেঞ্চুরি করার একটা আক্ষেপ অবশ্য ছিল মুশফিকের ইনিংসে। কিন্তু দল যখন ৫৬৫ করে ১১৭ রানের লিড নেয়, তখন বোধ হয় মুশফিকের সেই আক্ষেপ ঘুচে যায়। এদিন ৩০ রানের জয়ের লক্ষ্য ছুঁতে ৩৯ বলের বেশি খরচ হয়নি জাকির ও সাদমানের। তবে যে দল প্রথম ইনিংসে চার শতাধিক রান করে ইনিংস ডিক্লেয়ার্ড করেছে, সেই দলকে যে শেষ দিনে অলআউট করা যাবে, তাও আবার দেড়শর নিচে– এ স্বপ্ন কি দেখেছিলেন শরিফুল-হাসানরা?
ম্যাচের পর পুরস্কার মঞ্চে শান্তর কাছে এমনই জিজ্ঞাসা ছিল সঞ্চালকের। উত্তরে বার্থডে বয় শান্ত, ‘আগের রাতে আমি আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম, যদি এই ম্যাচ জিততে পারি, তাহলে সেটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় উপহার। আমি সেই উপহার পেয়েছি।’ ম্যাচ জয়ের এই বিশ্বাসটা প্রবল হয়, গতকাল প্রথম সেশন শুরু হওয়ার পরপরই। যখন শান মাসুদ ও বাবর আজমকে দ্রুত ফিরিয়ে দেন হাসান মাহমুদ ও নাহিদ রানা। এর পর পঞ্চম দিনে ভাঙা পিচে জাদু দেখাতে থাকেন সাকিব ও মিরাজ। সৌদ শাকিল ও আব্দুল্লাহ শফিককে অল্প রানের মধ্যেই ফিরিয়ে দেন সাকিব। পাকিস্তানের হয়ে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কেবল মোহাম্মদ রিজওয়ান। ৫১ রান করার পর মিরাজকে সুইপ খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান তিনি। ঠিক সেখানেই নিশ্চিত হয়ে যায় পিন্ডি না, ঢাকা। জয় উল্লাস উঠবে ঢাকাতেই।