পরপর দুই রাতে দুটি শিরোপা জয়! নাহ, চমকে ওঠার কারণ নেই। সত্যিই শিরোপা জয় করে ফেলেনি দুর্বার রাজশাহী। তবে ম্যাচ জিতেই তাদের উল্লাস ছিল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো! মজার ব্যাপার হলো, সেই উদযাপন মোটেও বাড়াবাড়ি মনে হয়নি। প্রেক্ষাপটই ছিল যে এমন! মাঠের বাইরে বিতর্ক আর সমস্যায় জর্জরিত দলটিই টানা তিন ম্যাচে চমক জাগানিয়া পারফরম্যান্সে এখন প্লে-অফে খেলার প্রহর গুনছে!
এবারের বিপিএলে বিতর্ক আর বিস্ময় দুটিই সমান দেখিয়ে চলেছে দুর্বার রাজশাহী।
নতুন এই ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে ঢাক গুড়গুড় ছিল টুর্নামেন্ট শুরুর আগে থেকেই। মূলত তাদের মালিকানা নিয়ে জটিলতা, মালিকানার হাতবদল, সত্যিকারের কর্ণদার নিয়ে সংশয়, এরকম নানা আলোচনা ছিল। পারিশ্রমিক নিয়ে তাদের অনিয়মও চলছে শুরু থেকেই।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ক্রিকেটারদের ৫০ ভাগ পারিশ্রমিক দেওয়া নিয়ম থাকলেও তারা দেয়নি এক পয়সাও। দলটির প্রথম ম্যাচের পর এ নিয়ে প্রশ্নও করা হয় তখনকার অধিনায়ক এনামুল হককে। পারিশ্রমিক না পাওয়ার কথা স্বীকার করে হাসিমুখে তিনি বলেন, এটা নিয়ে দুর্ভাবনাও নেই তাদের। কারণ, বিসিবির ওপর তাদের ভরসা আছে। বরং সংবাদকর্মীদেরকে তিনি বলেন, এসব নিয়ে খবর প্রকাশ না করতে।
সেই এনামুলরাই কয়েক দিন পর এমন একটি পদক্ষেপ বেছে নেন বা নিতে বাধ্য হন, যেটির খবর প্রকাশ না করে উপায় নেই। বরং বাংলাদেশ ছাপিয়ে ক্রিকেট বিশ্বেই সেটি ছড়িয়ে পড়ে।
পারিশ্রমিক নিয়ে দুর্ভাবনা নেই বলে এনামুল শুরুতে দাবি করলেও একটা পর্যায়ে তারা গভীর শঙ্কায় পড়ে যান। ঢাকার প্রথম পর্ব শেষে সিলেট পর্ব শেষ করে চট্টগ্রামে গিয়েও যখন তারা পারিশ্রমিক পাননি, তারা অনুশীলন বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেন। সমস্যার সমাধান না হলে তখন ম্যাচ বর্জন করার সিদ্ধান্তও তারা নিয়ে রেখেছিলেন। বিসিবি কর্তাদের তৎপরতায় তখন একটি সমাধান হয়। ক্রিকেটাররা অনুশীলনে ফেরেন।
পারিশ্রমিক নিয়ে নানা বিতর্ক ও টানাপোড়েন তবু চলতেই থাকে। এর মধ্যে পরিবর্তন আনা হয় তাদের নেতৃত্বে। গত ১৯ জানুয়ারি অপরাজিত সেঞ্চুরি করেও একটুর জন্য দলকে জেতাতে পারেননি অধিনায়ক এনামুল হক। পরদিনই দলের পরের ম্যাচের আগে হুট করে জানানো হয়, এনামুলের জায়গায় অধিনায়ক করা হয়েছে তাসকিন আহমেদকে।
সেঞ্চুরি পরদিন নেতৃত্ব হারানোর ঘটনা বিরল বটে!
এসব নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই চট্টগ্রাম পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে দারুণ এক জয় পায় তারা। টানা আট ম্যাচ জিতে অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটতে থাকা রংপুর রাইডার্স প্রথম হারের স্বাদ পায় এই বিতর্ক-জর্জর রাজশাহীর কাছেই।
এটিকে তখন অঘটন হিসেবেই ধরা হয়েছে। এমনকি সামাজিক মাধ্যমে মজা করে রংপুর রাইডার্স বলেছে, পঁচা শামুকে পা কেটেছে তাদের।
সেই ‘শামুক’ যে আদতে কতটা পঁচা, সেটির নমুনা বোঝা যায় ঢাকায় ফিরে। রোববার ম্যাচের দিন সকালে আচমকা হোটেল বদলাতে হয় তাদের আবাসন নিয়ে জটিলতার কারণে। সেদিন সন্ধ্যায় ম্যাচ খেলার জন্য দল মাঠে আসে বিদেশি ক্রিকেটারদের ছাড়াই। কারণ, পারিশ্রমিক না পেয়ে মাঠে আসতে অস্বীকৃতি জানান দলের বিদেশী ক্রিকেটাররা!
টিম ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে ক্রিকেটারদের দুয়ারে কড়া নাড়লেও কেউ দরজা খোলেননি। বিসিবির পক্ষ থেকে পারিশ্রমিক নিয়ে আশ্বাস দেওয়া হলেও তারা বিশ্বাস করেননি।
সঙ্কট তখন গভীর। একাদশে অন্তত দুজন বিদেশি ছাড়া মাঠে নামার নিয়ম যে নেই! শেষ পর্যন্ত বিপিএল টেকনিক্যাল কমিটির বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেশি ১১ জন ক্রিকেটার নিয়ে মাঠে নামে দল।
শীর্ষে থাকা রংপুরের বিপক্ষে তাদের ইনিংস শেষ হয় ১১৯ রানেই। একপেশে এক ম্যাচের অপেক্ষাই তখন ছিল। কিন্তু দেশি একাদশ নিয়েই উজ্জীবিত পারফরম্যান্সে আবার রংপুরকে হারিয়ে দেয় তারা!
ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক তাসকিন আহমেদ খোলামেলাভাবেই জানিয়ে দেন, কত নাটকের স্বাক্ষী তারা হচ্ছেন, কতটা বিব্রতকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হচ্ছে।
সেই জয়ে প্লে-অফ সম্ভাবনা উঁকি দেয় তাদের। এরপর সোমবার সিলেট স্ট্রাইকার্সের বিপক্ষে ৫ উইকেটের জয়ে সেই সম্ভাবনা এখন দারুণ উজ্জল। প্রথম ৯ ম্যাচের কেবল ৩টিতে জিতে পরাজয়ের দুয়ারে থাকা দল এখন হ্যাটট্রিক জয়ে উঠে এসেছে তিন নম্বরে।
মাঠের বাইরে বিতর্কের এমন ঝড়ের মধ্যেই মাঠের ভেতরে এভাবে ঘুরে দাঁড়ানো অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়। হতে পারে, বাইরের সঙ্কটই দলকে আরও এককাট্টা করে তুলেছে, মাঠে কিছু করে দেখাতে জেদি করে তুলেছে ক্রিকেটারদের। সবশেষ দুটি ম্যাচে ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষা ও জয়ের পর তাদের উল্লাসের মাত্রাতেই ফুটে উঠেছে অনেক কিছু।
সিলেটের বিপক্ষে ম্যাচে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচ-সেরা হওয়া তরুণ অলরাউন্ডার এসএম মেহরব হোসেন বললেন, মাঠের বাইরের ব্যাপারকে মাঠে সঙ্গী করেন না তারা।
“পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে আমরা যখন মাঠে ঢুকি, তখন বাইরে কী হচ্ছে না হচ্ছে, এটার দিকে খুব বেশি মনোযোগ দেই না। বাইরের দিকটায় যত মনোযোগ দেব, তত মাঠের খেলায় খারাপ প্রভাব পড়বে। আমরা চেষ্টা করি বাইরের ব্যাপার বাইরে রাখতে, ভেতরের ব্যাপার ভেতরে।”
তবে বিতর্কের এমন তীব্র ঝড় দলকে যে একটুও নাড়িয়ে দেয়নি, তা নয়। মেহরব নিজেই আবার তা স্বীকার করলেন পরে।
“এটা একটু হলেও প্রভাব ফেলে… বলব না যে, প্রভাব একেবারেই ফেলে না। কারণ, বাইরে যখন অনেক বেশি বিতর্ক হয়, তখন পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে আমাদের জন্য তা খারাপ, প্রতিটি ক্রিকেটারের জন্য খারাপ। এই দলে জাতীয় দলের ক্রিকেটার আছেন একজন, এখনও তারা খেলছেন। এগুলো এরকমভাবে ভাবে যদি হয়, তাহলে তাদের ক্যারিয়ারের জন্য, আমাদের ক্যারিয়ারের জন্য খারাপই।”
অধিনায়ক তাসকিন জয়ের কৃতিত্ব দিলেন দলের বোলিং আক্রমণ আর সবার প্রবল আকাঙ্ক্ষাকে।
“জেতার জন্য মরিয়া ছিলাম আমরা। প্রক্রিয়া দারুণভাবে অনুসরণ করেছি সবাই। সেটির ফল পেয়েছি।”
“মেহরব ভালো বল করেছে। গোটা বোলিং বিভাগই ভালো করেছে। এজন্যই ওদেরকে ১১৯ রানে আটকে পেরেছি। এটা দলীয় খেলাম সম্মিলিত পারফরম্যান্স প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে, আমাদের মতো দলে সবার সহায়তা প্রয়োজন হয়। আমরা সেটি করতে পেরেছি।”
টুর্নামেন্টের প্রথম দল হিসেবে প্রাথমিক পর্বের ১২ ম্যাচ শেষ হয়ে গেছে তাসকিনদের। ১২ পয়েন্ট নিয়ে এখন পয়েন্ট তালিকার তিনে আছেন তারা। চিটাগং কিংসের ম্যাচ বাকি আছে তিনটি, খুলনা টাইগার্সের দুটি। এই দুই দলের পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করবে রাজশাহীর ভাগ্য।
তবে গত তিন ম্যাচে নিজেদের ভাগ্য যেভাবে ঘুরিয়ে দিয়েছেন তাসকিনা, এবারের বিপিএলের সবচেয়ে চমকপ্রদ অধ্যায়ের রচনা হয়েই গেছে।