মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে বিমান হামলার জন্য বিশদ পরিকল্পনা করে। কয়েক সপ্তাহ ধরে হুথি আগ্রাসনের প্রত্যক্ষ ফল ছিল গত সপ্তাহের যুক্তরাজ্য ও মার্কিন নেতৃত্বে রয়্যাল নেভির জাহাজসহ লোহিতসাগরে হুথি বিদ্রোহীদের ওপর আক্রমণ। উদ্দেশ্য অনুযায়ী হতাহতের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। তবে কৌশলগতভাবে, অপারেশনটি সফল হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। শিপিং রুট রক্ষা করা এবং আরেকটি অর্থনৈতিক মন্দা প্রতিরোধ করতে এমন যৌথ অপারেশন অনিবার্য ছিল। তা না হলে ব্রিটেনের নির্বাচনের বছরে রয়্যাল নেভির যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হওয়ার মতো এমন ঝুঁকিপূর্ণ মিশন কখনোই অনুমোদন পেত না। কিন্তু এখানে কি কোনো কৌশলগত পরিকল্পনা আছে? হুথি বিদ্রোহীরা যদি পালটা আক্রমণ করে, তাহলে কী হবে? হুথিদের সঙ্গে ব্রিটেনের যুদ্ধ কেমন রূপ গ্রহণ করবে? আর এই হুথিরাই-বা কারা? তাদের বিরুদ্ধে ব্রিটেন কীভাবে জয়লাভ করতে পারবে? এটাই এখন চিন্তার বিষয়!
বড় বিপদ হলো, পশ্চিমা বিশ্ব এখন মধ্যপ্রাচ্যে আরো একটি ক্রমবর্ধমান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে এবং ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়ার মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে, যা যে-কোনো সময় স্রোতের বিপরীতে যেতে পারে। হুথি বিদ্রোহীরা কোনো অজানা ছোটখাটো প্রতিপক্ষ নয়। তারা অস্ত্রে সুসজ্জিত ও প্রশিক্ষিত যোদ্ধা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা এখানে ইরানের প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে একে অন্যের মিত্র হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে ইরান ও সৌদি আরবের সম্পর্কে ফাটল ধরার পর হুথিরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
প্রায় সাত বছর ধরে সৌদি আরব ও তার স্থানীয় মিত্ররা হুথি বিদ্রোহীদের দমন করার চেষ্টা করে, যা শেষ পর্যন্ত সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে প্রক্সি-যুদ্ধের রূপ ধারণ করে। মানবিক বিপর্যয় ও দ্বিপক্ষীয় অচলাবস্থার প্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে চীনের মধ্যস্থতায় একটা শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সৌদি-ইরান সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয়। এখানে প্রশ্ন ওঠে, পশ্চিমা নেতৃত্বে ব্রিটেন কেমন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? সৌদি আরব ও তার মিত্ররা যেখানে হুথিদের পরিপূর্ণভাবে দমন করতে পারেনি, সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হুথি বিদ্রোহীদের প্রতিহত করতে পারবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিশ্বের বিভিন্ন পরাশক্তি এই অঞ্চলে নিরর্থক যুদ্ধে স্থবির হয়ে যুদ্ধ করে উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন করতে পারেনি। এবারও কি তেমন কিছুই ঘটতে যাচ্ছে?
সবচেয়ে হতাশাজনক ব্যাপার হলো, লোহিতসাগরে ইয়েমেনের মতো যুদ্ধবিদ্ধস্ত ও দরিদ্র দেশ এখন পশ্চিম ও ইসরাইল বনাম ইরানের প্রক্সি-যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধে লেবাননে হিজবুল্লাহ ও গাজায় হামাসের মতো ইরানের মিত্রদের মধ্যে সম্ভবত রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ও চীন বিভিন্ন ধরনের লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করছে। এই ধরনের প্রক্সি-যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থা তৈরি করতে পারে। কারণ এখানে অন্য দেশের মানুষের দ্বারা যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়, কিন্তু যে-কোনো সময় হেরে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলে তা সরাসরি ভয়াবহ সংঘর্ষে পরিণত হতে পারে। আফগানিস্তানে যা ঘটেছিল, তার চেয়ে মারাত্মক পরিণতি এখানে দেখা যেতে পারে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো লোহিতসাগরের শিপিং লেন কখনোই হাতছাড়া করবে না, বিশেষ করে ইসরাইল লোহিতসাগরে শিপিং আক্সেস ধরে রাখার জন্য প্রাণপণে লড়াই করবে।
৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলার পর হামাস আসলে এমন কিছুই চেয়েছিল, যদিও এসবকিছু আগে থেকেই পরিকল্পিত ছিল না। হামাস এই অঞ্চলে একটা বিস্তৃত অস্থিতিশীলতা চেয়েছিল, যা ইসরাইলের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। তারা একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। তারা পশ্চিম তীরে ও দক্ষিণ লেবাননে ইসরাইলের বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহকে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা এই অঞ্চলে তাদের হয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে সাহায্য করেছে।
এই বিশৃঙ্খলা হামাসের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ, কারণ এটা ইসরাইলের মিত্রদের মধ্যে দুর্বলতা তৈরি করবে, যারা ইতিমধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চীন-তাইওয়ান উত্তেজনার কারণে বেশ চাপের মধ্যে আছে। ইসরাইলকে কোণঠাসা করতে হামাসের জন্য এমন উত্তেজনা সুফল বয়ে আনবে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে প্রক্সি-যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ইসরাইল আগের মতো মার্কিন সামরিক সহায়তা পাবে না। সহজ কথায় বলতে গেলে হামাস চায়, ইরান তার পক্ষে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করুক।
এই যুদ্ধে যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে লক্ষ্যবস্তু করে আক্রমণ করে কিংবা ওয়াশিংটন যদি সরাসরি ইরান আক্রমণ করতে সম্মত হয়, তাহলে তা বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জন্য হবে অত্যন্ত সুখের সংবাদ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের (এবং উভয় পক্ষের বিভিন্ন মিত্রদের) মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ, যা অনেক দিন ধরে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। অবশেষে বাস্তবে পরিণত হবে। এটা কাল্পনিক মনে হতে পারে—এবং এই অর্থে কাল্পনিক যে, যুদ্ধ যখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে শুরু করে, তখন ভয়াবহতা কমাতে অনেকেই সংঘর্ষ এড়ানোর চেষ্টা করে। যেমন, বৈরুতে এক জন হামাস কমান্ডারকে ইসরাইলি গোয়েন্দা হত্যা করার পরও হিজবুল্লাহ ও লেবানন সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে ইসরাইলের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হতে অনিচ্ছুক ছিল।
কিন্তু এই মুহূর্তে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ছে এবং মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন ও তাইওয়ানের জন্য ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এসব উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলার কারণে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। শেষ পর্যন্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে যে পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল, তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। কিন্তু সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে আসা পশ্চিমা ট্যাঙ্ক রক্ষা করার জন্য ইয়েমেনে দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সুয়েজ ক্যানাল হাতছাড়া হওয়ার প্রায় সাত দশক পর ব্রিটেন এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়েছে। আবারও ব্রিটেন আন্তর্জাতিক শিপিংয়ের অবাধ প্রবাহে একটা আরব দেশ যেন বাধা প্রদান করতে না পারে, তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। অনেক বছর পর, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র এক পক্ষ হয়ে এমন একটা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, যেটা কখনো ব্রিটেনের লড়াই ছিলই না। এখানে ব্রিটেন কীভাবে এই সংঘর্ষ থেকে বেরিয়ে আসবে, সেটাই দেখার বিষয়।
লেখক: দি ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক
দি ইন্ডিপেনডেন্ট থেকে অনুবাদ :আব্দুল্লাহ আল মামুন