গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী বিমানবন্দর থেকে গ্র্যান্ড হোটেলে পৌঁছাতে বাসে ৪০ মিনিট লাগে। এই পথের দুই ধারে সারি বেঁধে বেশির ভাগ জায়গায় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা অপেক্ষায় ছিলেন ক্রিকেটারদের স্বাগত জানাতে। এই দৃশ্য দেখার পর ক্রিকেটারদের অনেকেই কানপুরকে নিরাপদ মনে করছেন। অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার হুমকি উপেক্ষা করে খেলায় মনোযোগ দেওয়ার ইচ্ছার কথাও জানান একজন।
বাংলাদেশের টেস্ট স্কোয়াডের ১৬ জনই অনুরূপ বিশ্বাস ধারণ করেন, তা কিন্তু নয়। নিরাপত্তা হুমকি বেশির ভাগ খেলোয়াড়কে ভাবালেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা থেকে কেউই প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি। আসলে হিন্দু মহাসভার মতো ধর্মভিত্তিক সংগঠনের হুমকি আতঙ্ক ছড়ানোর মতোই। বিসিবি কর্মকর্তারাই তো ঢাকায় বসে নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন। সেখানে হিন্দু মহাসভার প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, ধর্মঘটের ডাক ও প্রতিরোধের ঘোষণাস্থলে থাকা ক্রিকেটার ও কোচিং স্টাফের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে কোনো বিদেশি দলের পক্ষেই স্বাভাবিক ক্রিকেট খেলা সম্ভব নয় বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও বিসিসিআই ও কানপুর ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন টেস্ট ম্যাচ ঘিরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। কানপুর হিন্দু মহাসভার ২০ সদস্যের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে পুলিশ।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার অভিযোগে কানপুর ও গোয়ালিয়রের হিন্দু মহাসভার সদস্যরা ক্ষিপ্ত হন। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদে কানপুরে টেস্ট ও গোয়ালিয়রে প্রথম টি২০ ম্যাচ বয়কটের ঘোষণা দেয় তারা। এই দুই ভেন্যুতে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ আয়োজনের বিরোধিতা করে সংগঠনটি।
গোয়ালিয়রে সিরিজের প্রথম টি২০ ম্যাচটি বাতিল না করলে পিচ কুপিয়ে নষ্ট করার হুমকিও দিয়েছিলেন হিন্দু মহাসভার সহসভাপতি জয়বীর ভরদ্বাজ। সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নৃশংসতা চালানো হয়েছে, মন্দির ভাঙা হয়েছে। এ কারণে হিন্দু মহাসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, গোয়ালিয়রে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচে প্রতিবাদ জানানো হবে।’
ম্যাচের সময় ঘনিয়ে আসায় প্রতিবাদ জানাতে এক দিন আগে কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে সংগঠনটি। প্রথম টি২০ ম্যাচের দিন বন্ধ ডেকেছে তারা। এই বন্ধ নিয়ে হিন্দু মহাসভার সহসভাপতি বলেন, ‘হিন্দু মহাসভা ম্যাচের দিন গোয়ালিয়র বনধের ডাক দিয়েছে। এই বন্ধের আওতামুক্ত থাকবে নিত্যপণ্য।’
দ্বিতীয় টেস্টের ভেন্যু কানপুর গ্রিন পার্ক স্টেডিয়ামে যাওয়ার পথে আগুন জ্বালিয়ে সোমবার বিশেষ রীতি পালন করেছে স্থানীয় হিন্দু মহাসভা। ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত অমান্য করে হুমকি ও শান্তি নষ্ট করার অভিযোগে কানপুর পুলিশ স্থানীয় হিন্দু মহাসভার ২০ জন সদস্যের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে বলে জানা গেছে।
বিমানবন্দর, টিম হোটেল, স্টেডিয়ামসহ ক্রিকেট দলের যাতায়াতের পথে নিরাপত্তা জোরদার করতে ব্যাপকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। চেন্নাই থেকে কানপুরে দু’দলের ক্রিকেটারদের আগমন উপলক্ষে সিরিজ কাভার করতে ভারতে আগত সাংবাদিকদেরও দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এককথায় বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে বাংলাদেশ দলকে। কানপুর পুলিশের এসিপি হরিশচন্দ্র বলেছেন, ‘আমরা নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যালোচনা করছি। এর জন্য কোনো কিছুই বাদ রাখিনি। পর্যাপ্ত পুলিশ নিয়োজিত থাকছে টেস্ট ম্যাচটি ঘিরে।’
হুমকি থাকলেও বিসিসিআই ভেন্যু পরিবর্তন করেনি। দেশটির ক্রিকেট বোর্ডের মহাসচিব জয় শাহ এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের সভা মালয়েশিয়ায় চলাকালে বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদকে দুশ্চিন্তা না করার অনুরোধ জানান।
তিনি জানিয়েছিলেন, কানপুর ও গোয়ালিয়রে উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা দেওয়া হবে খেলোয়াড়দের। গতকাল কানপুরে সে রকম নিরাপত্তা দেখা গেছে। এ ব্যাপারে বিসিবি সিইও নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমরা বিসিসিআইর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। তারা আমাদের নিশ্চিত করেছে, বাংলাদেশ দল ভারতের সব ভেন্যুতেই নিরাপদ। আসলে এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্বাগতিক বোর্ডের ওপর নির্ভর করতে হয়।
আশা করি, সবকিছু ভালোভাবে হবে।’ স্থানীয় একজন সাংবাদিকের মাধ্যমে গ্রিন পার্কের এক কর্মকর্তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে জানতে চাওয়া হলে নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘যারা হুমকি দিয়েছে, তারা তো দেশের সবকিছু না। এ জন্য তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। আর বাংলাদেশ এখানে খেলতে এসেছে ভারতের বিরুদ্ধে। এখানে রাষ্ট্র জড়িত।
বিসিসিআইর সম্মান জড়িত। আমাদের সম্মান জড়িত। আমরা জানি কিছু হবে না। এর পরও সতর্ক থাকতে হয়। বাড়তি নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আপনাদের অনুরোধ করব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য।’
বিসিবির মিডিয়া ম্যানেজার রাবীদ ইমাম জাতীয় দলের নিরাপত্তা প্রটোকল ও মিডিয়া ম্যানেজারের ভূমিকায়ও আছেন। গতকাল কানপুরে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে নিরাপত্তা নিয়ে একটুও চিন্তিত নন তিনি। রাবীদ সমকালকে ফোনে বলেন, ‘এখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে আমাদের হোটেলের দূরত্ব ৪০ মিনিটের।
পথের দুই পাশে দাঁড়িয়ে মানুষ আমাদের স্বাগত জানিয়েছে। স্কুলের ছেলেমেয়েরা অভিনন্দন জানিয়েছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে, কানপুরের মানুষ স্পোর্টিং। এখন ম্যাচ খেলতে কোনো সমস্যা নেই।’ ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে কানপুর টেস্ট। গোয়ালিয়রে প্রথম টি২০ ম্যাচটি হবে ৬ অক্টোবর।