চেয়েছিলেন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে টেস্ট ক্রিকেট শেষ করতে। অথচ সেই প্রিয় হোম অব ক্রিকেটের দেয়ালজুড়ে নেতিবাচক সব মন্তব্য লেখা। দেশে ফেরার সুযোগ না পাওয়ায় ওই সব দেখতে হবে না তাঁকে। কারণ, নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে সাকিবকে বুধবার দেশে না ফেরার পরামর্শ দেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। দেশের মাটিতে সাকিবকে বিদায়ী টেস্ট খেলতে দেওয়া, না দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে লড়াই চলছে।
বৃহস্পতিবার একটি পক্ষ বিসিবি কার্যালয়ের সামনে সাকিবকে জাতীয় দল থেকে বাদ দেওয়ার দাবি তোলে। গতকাল স্টেডিয়ামের সামনের সড়কে জড়ো হয়েছিলেন সাকিব ভক্তরাও। ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে মিছিল করে প্রিয় খেলোয়াড়ের বিদায়ী টেস্ট খেলার সুযোগ দেওয়ার দাবি জানান তারা।
যদিও তাদের এই দাবি এখন মূল্যহীন। কারণ, ঢাকা টেস্টের দল থেকে সাকিবের জায়গায় নেওয়া হয়েছে হাসান মুরাদকে। স্কোয়াডে এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিসিবি কি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, দেশের মাটিতে জাতীয় দলের জার্সিতে সাকিবের আর খেলা হবে না? তবে কি দেশে ফিরতে না দেওয়ার আক্ষেপ আর বিদায়ী টেস্ট খেলতে না পারার হতাশা নিয়েই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ করতে হবে দেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারকে? জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটাররা বাঁহাতি অলরাউন্ডারের শেষটা এভাবে দেখতে চান না।
তারা মনে করেন, দেশের মাটিতে বিদায়ী সংবর্ধনা নিয়ে টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করার অধিকার আছে সাকিবের। সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার বলেন, ‘আমি এখনই শেষ দেখতে চাই না। আরও কিছুদিন অপেক্ষ করতে চাই। সাকিব ডিজার্ভ করে দেশের মাটিতে শেষ ম্যাচ খেলার।’
সরকারের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ায় ঢাকা টেস্টের দলে নেওয়া হয়েছিল সাকিবকে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বিদায়ী টেস্ট খেলতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পথে ছিলেন তিনি। দুবাইয়ের যাত্রাবিরতিতে পেলেন ঢাকার ফোন। দেশে ফিরতে নিষেধ করা হয় তাঁকে। এর পরও বিশ্বের অন্যতম সেরা এ অলরাউন্ডার অপেক্ষায় ছিলেন ইতিবাচক কিছুর আশায়। তিনি উল্টো জানলেন, তাঁর ফেরার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে প্রতিবাদ হওয়ায়। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসানের কাছে এই প্রক্রিয়া রহস্যজনক মনে হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘উপদেষ্টাই বলেছিলেন, মিরপুরে বিদায়ী টেস্ট খেলতে কোনো সমস্যা নেই সাকিবের। এক দিনের ব্যবধানে এমন কী হলো, সে দেশে ফিরতে পারবে না? যারা প্রতিবাদ জানাল, তারা তো চেনামুখ। ফেসবুকই তো বলে দিচ্ছে কার সঙ্গে কার বন্ধুত্ব। আমি মনে করি, সাকিবের মতো একজন ক্রিকেটারকে বিদায়ী টেস্ট খেলার সুযোগ বঞ্চিত করা ঠিক না। এভাবে সাকিবের টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ হতে পারে না। আনুষ্ঠানিক বিদায় তাঁর প্রাপ্য। আমি আশা করব, সাকিব এভাবে ক্যারিয়ার শেষ করবে না।’
মিরপুরে সাকিবকে শেষ টেস্ট খেলার সুযোগ না দেওয়ায় খুবই হতাশ কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। গতকাল তিনি আবেগঘন এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি কখনোই এত রাগ বা কষ্ট লাগে নাই, আজ কেন যেন লাগছে, আমরা মানুষ কি কখনও নিজেরা ভুল করি না? কেউ অনুতপ্ত হলে তাকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি মানুষ হিসেবে, দয়ামায়া জিনিসটা আমাদের মধ্যে থেকে উঠে গেছে।’ তিনি যোগ করেন, ‘একটা মানুষ দেশের জন্য ১৭টা বছর কিছু না কিছু করেছে, আজ ক্রিকেটবিশ্ব আমাদের একটু সম্মান করে কাদের জন্য? তারা ক্রিকেট মাঠে নামতে পারবে না, এই কান্না তো সবাই দেখবে না।
রাজনীতি করেছে বলে এরা খুনি??? এদের সাথে মিশেছেন? এরা কত মানুষের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে, জানেন আপনি? এরা কত অসহায় মানুষের চিকিৎসা করিয়েছে, সেটা কি জানেন?’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্ট্যাটাস না দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে সালাউদ্দিন লেখেন, ‘তারা স্ট্যাটাস না দেওয়ার কারণে আজ শত্রু। যখন মাশরাফি ৫টা অপারেশন করে দেশের জন্য লড়াই করেছে, তা কি দেখেছেন? সাকিব যে আঙুলে চিড় নিয়ে বোলিং করে গেছে, তামিম এক হাতে ব্যাটিং করে গেছে, কাদের জন্য? দেশকে সবাই কম-বেশি ভালোবাসে। এদের ভালোবাসাটা হয়তো দেখা যায়ও না। এদের কাছ থেকে দেখেছি। এরা মানুষের উপকার ছাড়া কারও ক্ষতি করেনি, এরা খুনি না।’ জাতীয় দলের সাবেক এ সহকারী কোচের স্ট্যাটাস মূল ধারার গণমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছে।
বিসিবির স্কোয়াড থেকে সাকিবকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে গতকাল মিছিল হয়েছে মিরপুরে। স্টেডিয়ামের সামনে শত শত সাকিবভক্ত মিছিল করেছেন প্রিয় খেলোয়াড়ের বিদায়ী ম্যাচ খেলার সুযোগ চেয়ে। একজন সমর্থক বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ক্রিকেটকে ভালোবাসি। যেখানে সাকিব আল হাসান ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে এ দেশকে অনেক কিছু দিয়েছেন। আমরা রাজনীতির কেউ নই এবং খেলোয়াড় সাকিবকে ভালোবাসি। তাঁকে মাঠে ফেরানোর জন্য যে যে প্রক্রিয়া আছে, সেসব যেন ব্যবস্থা করা হয়। যারা বলতেছে, সাকিব খুনি ও স্বৈরাচারের দোসর; সেসব দেখার জন্য সরকার আছে, আইন আছে। সাকিব খুনি হলে তাঁর তো দেশে আসা আরও বেশি জরুরি।
এর পর আইন তাঁর বিচার করবে।’ যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টার কাছে নিশ্চয়ই এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আর নীরব দর্শকের ভূমিকায় সব দেখে যাওয়া বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদও দুবাই বসে ক্রিকেটের সব খবর রাখছেন নিশ্চয়ই।